শিরোপা দৌড়ে যেভাবে নিজেদের জানান দিল দ. আফ্রিকা
৯ অক্টোবর ২০২৩
বিশ্বকাপের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পর্কটা যেন কেবল বেদনার। হবেই না বা কেন, প্রত্যেক আসরেই ব্যাটে-বলে দাপুটে পারফরমেন্স দিয়ে শুরু করা দলটি শেষ পর্যন্ত শিরোপা জয় থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে থাকতে খালি হাতে আসর শেষ করে।
বিশ্বকাপ ইতিহাসও প্রোটিয়াদের পক্ষে কথা বলে না। বৃষ্টি বাধায় ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় কিংবা ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপের সুপার-সিক্সে হার্শেল গিবসের অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর ক্যাচ মিস ও সেমি-ফাইনালে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ল্যান্স ক্লুসনারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে অ্যালান ডোনাল্ডের সেই রান-আউট। হিসেবের গড়মিলে ঘরের মাঠে ২০০৩ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় অথবা ২০১৫ আসরের সেমি-ফাইনাল থেকে নিউ জিল্যান্ড অল-রাউন্ডার গ্র্যান্ট এলিয়টের ব্যাটে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় – বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের শিরোপা জয় নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে সন্দেহ তো তৈরি হবেই।
তবে শনিবার দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ১০২ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে তাদের নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে আরেকবার ভাবতে বাধ্য করেছে প্রোটিয়ারা। বিশ্বকাপের ঠিক আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে পিছিয়ে থাকার পরও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে তারা সিরিজ জেতে ৩-২ ব্যবধানে।
ব্যাটিংয়ে দারুণ ছন্দে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটাররা। ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যাটারদের র্যাঙ্কিংয়ে দলের পাঁচ ব্যাটার – কুইন্টন ডি কক, টেম্বা বাভুমা, রাসি ফর ডার ডুসেন, ডেভিড মিলার ও হাইনরিখ ক্লাসেনরা আছেন সেরা ১৫-র মধ্যে।
লঙ্কানদের বিপক্ষে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ দলীয় রানের সংগ্রহ করে প্রোটিয়া ব্যাটাররা যেন সব দলকে বার্তা দিলেন, শিরোপা দৌড়ে আমরাও আসছি। ডি কক, ফন ডার ডুসেন ও এইডেন মারক্রামের শতকে ৫ উইকেটে ৪২৮ রান পাহাড়ে ওঠে বাভুমার দল, যা কিনা বিশ্বকাপের এক ইনিংসে তিন ব্যাটারের সেঞ্চুরি হাঁকানোর প্রথম ঘটনাও।
শুরুতেই বাভুমার উইকেট হারানোর পর দলের ইনিংস গড়তে শুরু করেন ডি কক ও ফন ডার ডুসেন, যা পরবর্তীতে শুধু ছয় মারার প্রতিযোগিতা হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় উইকেটে ডি কক ও ফন ডার ডুসেন জুটি যোগ করেন ২০৪ রান। জুটির প্রথম ১০০ করতে যোগ করতে তারা নেন ১০৩ বল। বলের পর বল সীমানা পার করে পরের ১০৪ রান যোগ করেন মাত্র ৮১ বলে। বাঁহাতি ডি কক হাঁকান নিজের ১৮তম ওয়ানডে শতক।
প্রোটিয়া দলে থাকা ফন ডার ডুসেন হলেন বিশ্বের আন্ডাররেটেড ব্যাটারদের মধ্যে একজন। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের জন্য টিভি চালু করলেই দেখা যাবে ডানহাতি এই ব্যাটার যেন ৪০ রানে অপরাজিত আছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক মারক্রামের রয়েছে স্বপ্নিল ব্যাটিং কৌশল। লঙ্কানদের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে তিন ফরম্যাটে ১২৭ আন্তর্জাতিক ম্যাচে সেঞ্চুরি ছিল মাত্র আটটি। তবে ক্যারিয়ারের নবম শতকটি ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে থাকবে আজীবন। ৪৯ বলে শতক হাঁকিয়ে গড়েন বিশ্বকাপে দ্রুততম শতকের রেকর্ড।
মারক্রামের এসব কীর্তিতে ব্যাট হাতে প্রোটিয়াদের খুব একটা দরকার পড়েনি একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা ছন্দে থাকা ব্যাটার ক্লাসেনকে। এদিন দর্শকরা ক্লাসেনের ২০ বলে ৩ ছক্কায় ৩২ রানের ঝলক দেখেন মাত্র। এ বছর ব্যাট হাতে ঝড় তোলা ক্লাসেনের গড় ৫৯ ও স্ট্রাইক-রেট ১৫১। মাসখানেক আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেন মাত্র ৮৩ বলে ১৭৪ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস।
দলের ব্যাটিং অর্ডারের শেষ অস্ত্র মিলারের কথা ভুললে চলবে না। ছয় নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামা বাঁহাতি এই হার্ড-হিটার লঙ্কানদের বিপক্ষে খেলেন ৩৯ রানের এক ঝড়ো ইনিংস। এ বছর মিলার, ক্লাসেন, মারক্রাম, বাভুমা ও ডি কক প্রত্যেকের গড় ৪০ এর উপর।
এছাড়াও পাকিস্তান ও ভারতের পর গত বছরের শুরু থেকে বেশি ম্যাচ জয় প্রোটিয়াদের।
তবে ব্যাটিংয়ে প্রতিপক্ষের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া প্রোটিয়া দলে রয়েছে আগুনঝরা বোলারের কমতি। পিঠের সমস্যার কারণে টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ছিটকে পড়েন মূল অস্ত্র আনরিখ নরকিয়া।
কাগিসো রাবাদা বিশ্বসেরা, লুঙ্গি এনগিডি ভয়ঙ্কর এবং জেরাল্ড কুটসিয়া প্রতিভাবান হলেও ৮ ছক্কায় ৭৮ রান করে কুশল মেন্ডিস একাই দেখিয়ে দিয়েছেন এদেরকে সামলানো খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না।
দারুণ দুই বলে লঙ্কান দুই ওপেনারের স্ট্যাম্প ভাঙলেও ম্যাচে ৯২ রান দেন আরেক পেসার মার্কো ইয়েনসেন।
ফিল্ডিংয়েও দলের উন্নতির সুযোগ রয়েছে। লঙ্কানদের ম্যাচে দুটি ক্যাচ মিসের পাশাপাশি বেশ কিছু রান-আউটের সুযোগ হাত ছাড়া করেন ফিল্ডাররা।
ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের যেখানে নিজেদের ছন্দ খুঁজে পেতে সময় লাগছে, লঙ্কানদের বিপক্ষে এক ম্যাচ দিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকা বুঝিয়ে দিয়েছে সোনালি শিরোপার দাবিদার তারাও।
মন্তব্য করুন: