ওয়ার্নের ভবিষ্যদ্বাণীকেই যেন সত্যি করলেন ক্যাপ্টেন কামিন্স

৩১ ডিসেম্বর ২০২৩

ওয়ার্নের ভবিষ্যদ্বাণীকেই যেন সত্যি করলেন ক্যাপ্টেন কামিন্স

তখনও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়নি প্যাট কামিন্সের। পেশাদার ক্রিকেটে পথচলা শুরু করেছেন মাত্র দিন কয়েক আগেই। কিন্তু তার ক্যারিয়ারের তৃতীয় ম্যাচে শেষ হতেই কিংবদন্তি অজি লেগ-স্পিনার শেন ওয়ার্ন এক টুইটে জানান, কামিন্সের সামনে বড় কিছু অপেক্ষা করছে। সে টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। তখন কি কেউ ভেবেছিল যে এক যুগ পর ওয়ার্নের এই ভবিষ্যদ্বাণী একদম সত্যি হয়ে যাবে? কিংবা কামিন্সের হাত ধরেই প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বা ষষ্ঠবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ ঘরে তুলবে অস্ট্রেলিয়া?

২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি বিগ ব্যাশ লিগে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে পেশাদার ক্রিকেটে অভিষেক হয় ১৭ বছর বয়সী কামিন্সের। তাসমানিয়ার বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচেই শিকার করেন ৩ উইকেট। আর ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে নেন এক উইকেট।

২৪ জানুয়ারি নিজের তৃতীয় ম্যাচে একাই কুইন্সল্যান্ডের টপ-অর্ডার গুঁড়িয়ে দেন কামিন্স। ম্যাচে ৪ ওভার বল করে ২৪ রান খরচায় ৩ উইকেট নিয়ে দলের জয়ে বড় অবদান রাখেন তরুণ এই পেসার। আর কামিন্সের বোলিং দেখে সেদিন কিংবদন্তি ওয়ার্ন টুইট করেন, “অসাধারণ। নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে টি-টুয়েন্টি ম্যাচে কামিন্স কী দুর্দান্ত পারফরমেন্সই না করেছে। বড় ভবিষ্যৎ - সে আমাদের টেস্ট বোলিং আক্রমণের নেতা হতে পারে। সতেজ ও দেখতে ক্ষুদার্থ।”

ওয়ার্নের কথায় যে খুব একটা ভুল ছিল না তা প্রমাণ হতে বেশি সময় লাগেনি। সে বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্য ১৮ বছর বয়সেই অস্ট্রেলিয়া ডাক পান কামিন্স। কেপ টাউনে অভিষেক টি-টুয়েন্টিতে ২৫ রানে তুলে নেন তিন উইকেট। এরপর সেঞ্চুরিয়নে ওয়ানডে অভিষেকও শিকার করেন তিন উইকেট।

জোহানেসবার্গে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে অজিদের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে অভিষেক হয় কামিন্সের। আর অভিষেক ম্যাচেই আগুন ঝরানো বোলিংয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে তুলে নেন ছয় উইকেট। সঙ্গে মেলে ম্যাচসেরার খেতাবও। তবে এই ম্যাচে গোঁড়ালির চোটে পড়েন কামিন্স।

অভিষেক টেস্টেই আমলা, ক্যালিস ও ভিলিয়ার্সের উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচসেরা হন কামিন্স ২০১২ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেললেও চোটের কারণে আবার দল থেকে ছিটকে যান কামিন্স। এরপর ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে ওয়ানডে বিশ্বকাপেও খেলেন। কিন্তু তখনও ইনজুরির থাবায় ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটে মাঠে নামা হয়নি ডানহাতি এই পেসারের। আসলে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াই কামিন্সকে নিয়ে খুব সতর্ক ছিল। তাকে পুরোপুরি ফিট করে টেস্ট খেলানোর পক্ষে ছিল তারা। অবশেষে ২০১৭ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে মিচেল স্টার্ক চোটে পড়লে তার বদলি হিসেবে পাঁচ বছর পর সাদা পোষাকে মাঠে নামেন কামিন্স। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

ওয়ার্নের করা ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই যেন জশ হ্যাজেলউড আর স্টার্কের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ার পেসত্রয়ীর নেতা হয়ে ওঠেন কামিন্স। ২০১৯ সালে পান টেস্ট দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব। আর ২০২১ সালের নভেম্বরে টিম পেইন অস্ট্রেলিয়ার সাদা পোষাকের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ালে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলের ৪৭তম অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান কামিন্স। দলকে প্রথমবার নেতৃত্ব দিয়েই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজ সিরিজ জিতে নেন।

পরের বছর অ্যারন ফিঞ্চ ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসর নিলে অস্ট্রেলিয়ার রঙ্গিন পোশাকের দলের নেতৃত্বর ভারও পড়ে কামিন্সের কাঁধে। বিশ্বকাপের আগে মাত্র চার ম্যাচে অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসর শুরু করেন তিনি। প্রথম দুই ম্যাচে হেরে বেশ পিছিয়ে থেকেই টুর্নামেন্ট শুরু করলেও তার নেতৃত্বে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ায় অজিরা। আর ফাইনালে তো কামিন্সের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিনায়কত্বের কাছে পাত্তাই পায়নি স্বাগতিক ভারত। রেকর্ড ষষ্ঠবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে জেতান বিশ্বকাপের সোনালি শিরোপা।

কামিন্সের নেতৃত্ব গুনে শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার ভারতকে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় অজিরাতার আগে, গত জুনে এই ভারতকে হারিয়েই প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা এনে দেন কামিন্স। এরপর ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজ ড্র করে ছোট্ট ছাইদানির ঐতিহ্যবাহী ট্রফিটি উঁচিয়ে ধরেন।

এত সাফল্যের ২০২৩ সালটা কামিন্স শেষ করেন ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৯ বছর অপরাজিত থাকার রেকর্ড অক্ষুন্ন রেখে। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ জিতে ইতিমধ্যেই সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছে স্বাগতিকরা। তবে সদ্য শেষ হওয়া মেলবোর্ন টেস্টে পাকিস্তানের সামনে সুযোগ ছিল ২৯ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে জয় নিয়ে ফেরার। কিন্তু কামিন্সের পেস তোপে তা আর পেরে ওঠেনি সফরকারীরা। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০ উইকেট নিয়ে একাই ম্যাচের ঘুড়িয়ে দেন ডানহাতি এই পেসার। একই সঙ্গে একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে এক ম্যাচে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্বও এখন কামিন্সের।

কামিন্সের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপও জেতে অজিরাএকজন চোটপ্রবণ পেসার থেকে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হয়ে যাওয়া কামিন্সের উত্থানে বড় অবদান ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার। তারা খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করেনি। তাই তারা বছরের পর বছর বিনিয়োগ করেছিল কামিন্সের ওপর। তৈরি করেছিল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তাই এত বছর পর এসে কিংবদন্তি ওয়ার্নের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দিয়েছেন কামিন্স। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া পেয়েছে দুর্দান্ত এক অধিনায়ক।

মন্তব্য করুন: