ডেভিড ওয়ার্নার: ব্যাট হাতে যিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতেন
৬ জানুয়ারি ২০২৪
জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার আর মাত্র ১১ রান। ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটে নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে দলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার অপেক্ষায় থাকা ডেভিড ওয়ার্নার তখন ব্যাট করছিলেন ব্যক্তিগত ৫৭ রানে। সাজিদ খানের করা ২৫তম ওভারের পঞ্চম বলে এলবিডাব্লিউর জোরালো আবেদন জানান পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা। আম্পায়ার আবেদন নাকচ করে দিলেও রিভিউতে দেখা যায় বলটি লেগ-স্ট্যাম্পে আঘাত হেনেছে।
ততক্ষণে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের প্রায় ২৪ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে করতালিতে অভিবাদন জানাতে শুরু করেছেন ওয়ার্নারকে। আর মাঠের বড় পর্দায় নিজের আউটের রিপ্লে দেখে একটু হাসলেন ওয়ার্নার। শেষবারের মতো ২২ গজকে বিদায় জানানোর সময় বাঁহাতি এই ওপেনারকে সবার আগে অভিনন্দন জানালেন সেই সাজিদ খানই। এরপর অপর প্রান্তে থাকা সঙ্গী মারনাস লাবুশেন আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। একে একে হাত মেলালেন প্রতিপক্ষের আরও অনেকে।
বিদায় বেলায় শেষবারের মতো হেলমেটে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার লোগোতে এঁকে দিলেন চুমু। হাঁটতে হাঁটতেই ব্যাট উঁচিয়ে দুহাত প্রসারিত করে সমর্থকদের অভিবাদনের জবাব দিলেন ওয়ার্নার। আর মাঠ ছেড়ে ড্রেসিং রুমের সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় শেষ ম্যাচের হেলমেট ও গ্লাভস জোড়া দিয়ে দিলেন এক ক্ষুদে সমর্থককে। এভাবেই শেষ হয় এক যুগের বেশি সময় ধরে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করা ওয়ার্নারের টেস্ট অধ্যায়। শেষ হয় ১১২ ম্যাচে ২৬ শতক ও ৮ হাজার ৭৮৬ রানের বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ার।
সাদা পোশাকে ওয়ার্নারের পথচলার শুরুটা হয় নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর ব্রিজবেনে। প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও দ্বিতীয় ম্যাচেই নিজের জাত চেনান আগ্রাসী এই ওপেনার। হোবার্ট টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেন ১২৩ রানের দারুণ এক ইনিংস। মাত্র ৭ রানের জন্য দলকে জেতাতে না পারলেও ঠিকই ম্যাচসেরার পুরস্কার নিজের করে নেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দলের নিয়মিত ওপেনার হিসেবে নিজেকে দ্রুতই প্রতিষ্ঠিত করেন। পরের সিরিজেই ভারতেই বিপক্ষে পার্থ টেস্টে খেলেন ১৫৯ বলে ১৮০ রানের বিধ্বংসী ইনিংস।
পুরো টেস্ট ক্যারিয়ারে ২৬ শতক হাঁকানো ওয়ার্নার ২০টিই হাঁকিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৯ ম্যাচ খেললেও সেখানে কোনো শতকের দেখা পাননি। শতক নেই ভারতের মাটিতেও। তবে ব্যাটারদের জন্য বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকায় হাঁকিয়েছেন ৩টি শতক। ভারতের স্পিনিং কন্ডিশনে না পারলেও বাংলাদেশে খেলা দুই ম্যাচে ২টি শতকের দেখা পেয়েছেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। ক্যারিয়ারে দুটি দ্বিশতক ও একটি তিনশ রানের ইনিংস খেলা ওয়ার্নার এক ম্যাচেই দুইবার শতক হাঁকিয়েছেন মোট তিনবার।
অন্যদিকে, ১২ বছরের ক্যারিয়ারে ১২জন ভিন্ন ওপেনিং পার্টনারের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন ওয়ার্নার। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৪১ বার জুটি গড়েছেন ক্রিস রজার্স ও বাল্যবন্ধু উসমান খাজার সঙ্গে। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ ইংল্যান্ড (৩৩) ও ভারতের (২১) সঙ্গে খেললেও ওয়ার্নারের প্রিয় প্রতিপক্ষের তালিকায় সবার উপরের দিকে হয়তো পাকিস্তানের নামটাই থাকবে। কেননা নিজের ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ৩৩৫ রানের অপরাজিত ইনিংসটি তো তিনি খেলেছেন এশিয়ার এই দেশটির বিপক্ষেই। এছাড়াও দলটির বিপক্ষে ১৩ ম্যাচে ৬ শতক ও ৫ অর্ধ-শতকে ৭৩ দশমিক ৯০ গড়ে রান করেছেন ১ হাজার ৫৫২।
ওয়ার্নারকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরাদের একজন বলা যাবে কি না তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু পরিসংখ্যানের হিসেবে তিনি যে ইতোমধ্যেই দেশটির একজন কিংবদন্তি ব্যাটার হয়ে গেছেন তা বললে হয়তো কোনো ভুল হবে না। দেশটির টেস্ট ইতিহাসে তার চেয়ে বেশি রান আছে মাত্র চার জনের। তারা হলেন – রিকি পন্টিং (১৩ হাজার ৩৭৮), অ্যালান বর্ডার (১১ হাজার ১৭৪), স্টিভ ওয়াহ (১০ হাজার ৯২৭) এবং সতীর্থ স্টিভ স্মিথ (৯ হাজার ৫১৪*)।
সদ্য বিদায়ী এই ওপেনারের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো আগ্রাসী মেজাজে ব্যাট চালিয়ে দ্রুত রান তোলা। আর তাই তো ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৭০ দশমিক ১৯ স্ট্রাইক-রেটে রান তুলে। ৮ হাজার রান করা ওপেনারদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি স্ট্রাইক-রেট আছে কেবল একজনেরই। আর তিনি হলেন ভারতের মারকুটে ব্যাটার বীরেন্দ্র শেবাগ। বিদায়বেলায় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, লোকে তাকে কীভাবে মনে রাখবে? আর সহজসরলভাবে ওয়ার্নার উত্তর দেন, “রোমাঞ্চকর ও বিনোদনদায়ী একজন হিসেবে… খেলার ধরন দিয়ে যে লোকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।”
মন্তব্য করুন: