সিকিউরিটি গার্ড থেকে ক্যারিবিয়ান রূপকথার নায়ক
২৯ জানুয়ারি ২০২৪
তার জন্ম হয়েছিল এমন এক গ্রামে, যেখানে এখনো আধুনিক জীবনযাপনের তেমন কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। গায়ানার রাজধানী জর্জটাউন থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক দূরের বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ বারাকারা। ২২৫ কিলোমিটার দুর্গম নদীপথ পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। মোট জনসংখ্যা সাড়ে তিনশর মতো। একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই! সেই জায়গা থেকে উঠে এসে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২৭ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্ট জয় এনে দেওয়া ক্রিকেটারটির নাম শামার জোসেফ!
জোসেফের জন্ম ১৯৯৯ সালের অগাস্টে। তার গ্রামের মানুষের মূল পেশা কৃষি আর গাছ কাটা। সেখানে একটিমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক এসেছে ২০১৮ সালে! ভালো চিকিৎসা পেতে হলেও তাদেরকে দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় নিউ আমস্টারডাম শহরে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছিল জোসেফের। কিন্তু খেলার সরঞ্জাম পাবেন কোথায়? ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেই কৃষিকাজের ফাঁকে লেবু বা পেয়ারা দিয়ে বোলিং করতেন। মাঝেমধ্যে নিউ আমস্টারডাম শহরে যেতেন। এভাবেই একদিন হাতে পেলেন টেপ টেনিস বল।
এক পর্যায়ে নিউ আমস্টারডাম শহরের ‘টাকবার পার্ক’ নামের একটি ক্লাবে তিনি সুযোগ পান। ওই ক্লাবেই খেলেছেন আরেক ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার রোমারিও শেফার্ড। সেই সময় কোর্টনি ওয়ালশ ও কার্টলি অ্যামব্রোসের গল্প শুনে নিজেকে ফাস্ট বোলার হিসেবে কল্পনা করতে থাকেন। সে লক্ষ্যেই শুরু করেন অনুশীলন। কিন্তু শামার জোসেফের জীবন তো এত সহজ ছিল না। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ক্রীতদাস। আফ্রিকা থেকে তাদের দাস হিসেবে আনা হয়েছিল। পরে দাসত্বের শেকল ভেঙে তারা সেখানে আবাস গড়েন। গায়ানার একমাত্র মেরুন গ্রাম হলো বারাকারা। যে গ্রামের মানুষ মোটেও ধনী নন। ক্রিকেট তো সেখানে বিলাসিতা।
শামার জোসেফরা পাঁচ ভাই তিন বোন। নিজেও অল্প বয়সে বিয়ে করেন। এসময় বাবাও হয়ে যান। তাই বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে একটি সিকিউরিটি ফার্মে চাকরি নেন। সেখানে তিনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী হিসেবেও কাজ করতেন। এত কিছুর পরও ক্রিকেটকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই ক্রিকেট খেলতেন। দ্রুতই বুঝতে পারেন, এভাবে খেললে ক্যারিয়ার গড়া যাবে না। তাই প্রচণ্ড আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। আবার পূর্ণ মনযোগ দেন খেলায়। বিভিন্ন ক্লাব ঘুরে একপর্যায়ে সুযোগ পেয়ে যান গায়ানা দলে। এই খবরে শামার জোসেফের গ্রামে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়! রীতিমতো উৎসব হয় তার গ্রামে।
জোসেফ তো এখানেই থেমে থাকার পাত্র নন। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা আর কঠোর পরিশ্রমে সব বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায়। ডাক পান সিপিএল দল গায়ানা অ্যামাজন ওয়ারিয়র্সে। সেই আসরে ভালো করতে না পারলেও গত নভেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলে ডাক পান। দুটি আনঅফিসিয়াল টেস্টে ১২ উইকেট নিয়ে জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে আসেন। তাই স্রেফ পাঁচটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেই ডাক পান জাতীয় দলে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডিলেড টেস্টে অভিষেক হয়ে যায়। টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম বলেই তুলে নেন উইকেট! সেই উইকেটটি ছিল ক্রিকেট দুনিয়ার অন্যতম সেরা ব্যাটার স্টিভেন স্মিথের।
অ্যাডিলেডে প্রথম টেস্টটি হেরে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর এলো ব্রিজবেন টেস্ট, জোসেফের হাত দিয়েই লেখা হলো রূপকথার ইতিহাস। জোসেফের আগুনে বোলিংয়েই ২৭ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাও আবার স্মরণকালের দুর্বলতম দল নিয়ে পূর্ণশক্তির ভয়ংকর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে! আগের দিন পায়ে মারাত্মক চোট পাওয়ায় গত রোববার ম্যাচের চতুর্থ দিন তার মাঠে নামারই কথা ছিল না। কিন্তু চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি মাঠে নামেন। অধিনায়ক ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েটকে বলেন, অস্ট্রেলিয়ার সবগুলো উইকেট পতন না হওয়া পর্যন্ত তিনি বোলিং করে যাবেন। অতঃপর ১১.৫ ওভার বোলিং করে ৬৮ রানে ৭ উইকেট তুলে নেন ২৪ বছর বয়সী এই পেসার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে যায় ৮ রানে। ইতিহাস গড়ার সেই দৃশ্য মাঠে বসে দেখছেন ইয়ান বিশপ, কার্ল হুপার, ব্রায়ান লারার মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনালী দিনের মহানায়কেরা।
জোসেফের কারণেই তার গ্রাম বারাকারা এখন বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। হয়তো এখন দ্রুতই সেখানে আরও আধুনিক সুযোগ সুবিধা পৌঁছে যাবে। বদলে যাবে বাসিন্দাদের জীবনযাপন। আর দুই সন্তানের জনক জোসেফ মাতিয়ে যাবেন ক্রিকেট দুনিয়া। দৃঢ় সংকল্প থাকলে শত বাঁধা পেরিয়েও যে লক্ষ্যে পৌঁছা যায়- এই আপ্তবাক্যের সেরা উদাহরণটাই তো সৃষ্টি করলেন জোসেফ।
মন্তব্য করুন: