বাবা টেন্ডুলকারের মতো কেন হতে চাননি অর্জুন?
১৭ এপ্রিল ২০২৩
টানা চব্বিশ বছর ব্যাট হাতে ক্রিকেটবিশ্ব শাসন করেছেন বাবা। বিশ্বের বাঘা বাঘা বোলারদের সাথে লড়াই করে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে সিংহাসন। তাঁরই ছেলে ব্যাটের বদলে বেছে নিলেন বল! ভারতীয় ব্যাটিং কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুুলকারের ছেলে অর্জুন টেন্ডুলকার কিনা বোলার!
ক্রিকেটীয় দিক থেকে বাবার সাথে অমিলের অবশ্য এখানেই শেষ নয় ছেলের। ব্যাটিং-বোলিংয়ে বাবা ছিলেন পুরোদস্তুর ডানহাতি। আর ছেলে অর্জুনের কাছে ক্রিকেট ‘বাঁ হাতের খেল’। বল হাতে শচীনকে বিভিন্ন রূপেই দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মিডিয়াম পেস বল করতেন। পরবর্তীতে অফ স্পিন এবং লেগ স্পিনও করেছেন। তবে মিচেল স্টার্ক এবং বেন স্টোকসকে আদর্শ মানা অর্জুন বাঁহাতি মিডিয়াম পেস বোলার।
কেন?
২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বেই ভারতের শোচনীয় বিদায়। হাজারও ভক্তের সাথে মন ভেঙ্গেছিল আট বছর বয়সী শিশুটিরও। তখন ভারতীয় দলে মূল দুর্বলতা ছিল পেস বোলিং। সেই থেকে বাবার মতো ব্যাটার না হয়ে টেন্ডুলকার পুত্রের ইচ্ছে বোলার হবার। বল হাতে জাতীয় দলের পেস অ্যাটাককে নেতৃত্ব দেবার।
সে পথেই বড় এক পদক্ষেপ এই আইপিএল অভিষেক।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। ঠিক ১০ বছর আগে বাবা যেখানে খেলেছিলেন আইপিএলের শেষ ম্যাচ। ২০১১ সালে উঁচিয়ে ধরেছিলেন বিশ্বকাপের শিরোপা। ঠিক সেখানেই ছেলে অর্জুনের আইপিএল অভিষেক। সেই মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের হয়েই।
২০১৩ সালের নভেম্বরে এই স্টেডিয়ামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শচীন খেলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিদায়ী ম্যাচ। ম্যাচ শেষে পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে দর্শকদের ‘শচীন, শচীন’ চিৎকার যেন আজীবন মিশে থাকবে ওয়াংখেড়ের সাথে। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ২০০ টেস্টে এবং ১৫ হাজারের বেশি রানের মালিকের বিদায় মুহূর্ত বলে কথা!
ছেলে অর্জুনের পথচলাটা নতুন। ২০২১ আইপিএলে প্রথমবারের মতো ডাক পান। ২০ লাখ রুপিতে তাঁকে দলে নেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। কিন্তু সেবারের আসর কাটিয়েছেন ডাগ আউটে বসেই। ২০২২ সালের নিলামে নতুন দল গুজরাট টাইটানস তাঁকে দলে ভেড়ানোর আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত ৩০ লাখ রুপিতে আবারও মুম্বাইয়ে অর্জুন। কিন্তু সে মৌসুমেও কোন ম্যাচের একাদশে সুযোগ হয়নি টেন্ডুলকার পুত্রের।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হল অবশেষে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো মুম্বাইয়ের একাদশে অর্জুন। বল হাতে তুলে দেয়া হয় প্রথম ওভারেই।
অর্জুনের প্রথম ওভারটি বেশ ভালো। দেন মাত্র চার রান। পরের ওভারে ১৩ রান দিয়ে ফেলেন। আর বোলিংয়ে আনা হয়নি এই বাঁহাতি পেসারকে। ২ ওভারে ১৭ রান দিয়ে উইকেটশূন্য – আইপিএল অর্জুনের প্রথম ম্যাচের পরিসংখ্যানকে কী বলবেন? ভালো? মন্দ? নাকি মন্দের ভালো?
বোধহয় মন্দের ভালো বলাই যথার্থ। ২৩ বছর বয়সী এই পেসারের ক্যারিয়ারকেও সেটাই বলা যায়।
ক্রিকেটের প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে মাত্র আট বছর বয়সেই অর্জুনকে কোচিং ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেন শচীন। ২০১০ সালে পুনেতে অনূর্ধ্ব-১৩ টুর্নামেন্ট দিয়ে বল হাতে যাত্রা শুরু টেন্ডুলকার পুত্রের।
অর্জুনের হয়ে এই ওয়াংখেড়ে মনে করিয়ে দেয় আরও এক স্মৃতি। ২০১৫ সালের এক বিকেলে অর্জুনের নেট অনুশীলন। সাথে ছিলেন ওয়াসিম আকরাম, ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা বাঁহাতি পেসার। ১৫ বছর বয়সী উঠতি এই তরুণের জন্য এর থেকে ভালো নির্দেশক আর কে হতে পারত?
বাবা টেন্ডুলকারও পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন বল হাতে ছেলের আগ্রহের চিত্র। মাত্র ৩০ মিনিটের সেই অনুশীলনে হয়তো ওয়াসিম আকরাম তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন বল হাতে কীভাবে হতে হবে লম্বা রেসের ঘোড়া।
বছর দুই না যেতেই সফলতার দেখা। ২০১৭-১৮ মৌসুমে কোচবিহার ট্রফিতে মুম্বাই অনূর্ধ্ব-১৯ এর হয়ে মাত্র পাঁচ ম্যাচে ১৯ উইকেট শিকার করেন তিনি। এরপর ডাক পান ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে।
মুম্বাইয়ের নিজের প্রথম ম্যাচ খেলেন সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে। ২০২১ মৌসুমে হারিয়ানার বিপক্ষে ৩ ওভারের ৩৪ রান দিয়ে নেন এক উইকেট।
তখন পর্যন্ত নিজ ছেলের কোন ম্যাচ স্বচক্ষে দেখেননি শচীন। কেননা তিনি চাননি তাঁর উপস্থিতি ছেলের খেলায় কোন চাপ না পড়ুক। নিজের মতো করে খেলুক।
সামনে রনজি ট্রফির অভিষেক। তবে এবারের মুম্বাইয়ের হয়ে নয়। দল বদলে যান গোয়ায়। জাতীয় দলের বাইরে যেকোন ভারতীয় ক্রিকেটারের জন্য রনজি ট্রফি সর্বোচ্চ সম্মানের।
ছেলের এমন এক মুহূর্তে বাবার উৎসাহেও যেন ছিলনা কোন কমতি। অর্জুনের সর্বোচ্চ সাফল্যের ভীত গড়তে শরণাপন্ন যোগরাজ সিংর কাছে। অনুশীলন মাঠের কড়া এই কোচ ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার এবং কিংবদন্তি যুবরাজ সিংয়ের বাবা।
অর্জুনকে দেখে যোগরাজের প্রথম কথা, ‘ভুলে যাও তুমি কিংবদন্তি শচীনের ছেলে। গড়তে হবে নিজের আলাদা পরিচয়।’ যোগরাজের ১৫ দিনের সেই প্রশিক্ষণই যেন বদলে দিয়েছে অর্জুনের খেলার ধরণ। ফলাফল রনজি ট্রফির অভিষেক ম্যাচেই।
প্রথম শ্রেণির অভিষেকেই গড়েন অনন্য এক নজির। তবে বল হাতে নয়। নিজেকে এদিন মেলে ধরেন ব্যাট হাতে। করেন সেঞ্চুরি। এ যেন ৩৪ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
১৯৮৮ সালে বাবা শচীনও গড়েছিলেন একই কীর্তি। সেই রনজি ট্রফিতেই। অভিষেক ম্যাচেই। গুজরাটের বিপক্ষে পেয়েছিলেন সেঞ্চুরির দেখা। ব্যাট হাতে সময়ের বিবর্তনে দেশের ক্রিকেট দেবতায় পরিণত হয়েছেন শচীন। ছেলে বল হাতে নিজেকে প্রকাশ করলেও বাবার এমন রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন ব্যাট হাতেই।
এবার তো অর্জুনের আইপিএল অভিষেকটাও হয়ে গেল। যেদিন মুম্বাইয়ের ড্রেসিংরুমে ছিলেন স্বয়ং বাবা শচীন টেন্ডুলকার। স্টেডিয়ামে গিয়ে যাঁর খেলা দেখে কেটেছে অর্জুনের শৈশব-কৈশোর। আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই প্রথম নাকি ছেলের খেলা দেখলেন শচীন টেন্ডুলকার!
ম্যাচ শেষে সেটাই বলছিলেন তিনি, ‘আমি আগে কখনও অর্জুনের খেলা দেখিনি। এটা তাই আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। ওর উপর ক্রিকেটার হবার চাপ দিইনি। বরং ও যা করতে চায়, সেই স্বাধীনতা দিয়েছি সব সময়।’
অর্জুনের সেই চাওয়াটা ক্রিকেট ঘিরেই। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের নীল জার্সি পরে মা অঞ্জলি টেন্ডুলকার এবং বোন সারা টেন্ডুলকারের সাথে দর্শকমঞ্চ মাতাতেন একসময়। এবার সেই জার্সি পরেই বল হাতে ২২ গজের পিচে অর্জুন।
আরেক আরাধ্য ‘নীল জার্সি’র দিকেও কি তাতে আরেকটু এগুলেন অর্জুন? ভারত জাতীয় দলের! আইপিএলের অভিষেক ম্যাচের পর শচীন টেন্ডুলকারের ছেলের কথাটির অমন অর্থ করে নিতেই পারেন আপনি, ‘মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ও ভারত জাতীয় দলের ক্যাপ আমার কাছে সব সময়ই বিশেষ কিছু’।
মন্তব্য করুন: