ক্রিকেটে অবসাদ, ক্রিকেটেই আরোগ্য
২৫ এপ্রিল ২০২৩
রাগবি খেলোয়াড় এবং কোচের সন্তান মেতে থাকবেন রাগবি নিয়ে – সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ছেলে দৌড়ালেন ‘অস্বাভাবিক’ পথে। দৌড়ালেন ক্রিকেটের ব্যাট-বল হাতে। সেটিও ভিন দেশের হয়ে!
আর সেই ‘ভিন দেশ’ ইংল্যান্ডের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাটিয়ে দিয়েছেন এক যুগ। অর্জনের আলোয় উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন এমনভাবে, কিংবদন্তি বিশেষণটা জুড়ে দিতেই হবে বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকসের নামের আগে।
২০১৬ সালে ইডেন গার্ডেনসে সর্বহারার শূন্যতায় হাঁটু মুড়ে বসে থাকা সেই মানুষটার পরবর্তী রূপান্তরের গল্পটা কে কল্পনা করেছিলেন! সেবার তিনি ভিলেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ১৯ রান। ব্যাটিং তান্ডবে প্রথম চার বলেই গুনে গুনে টানা চার ছয়। কমেন্ট্রি বক্স থেকে ইয়ান বিশপের সেই স্মরণীয় চিৎকার, 'কার্লোস ব্রাথওয়েট রিমেম্বার দ্য নেম’।
ব্রাথওয়েটের নাম ভোলেনি ক্রিকেটবিশ্ব। কিন্তু বোলিং প্রান্তে অপরাধ স্বীকার করে মুখ ডেকে বসে থাকা ব্যক্তিটির নামও কি ভোলা সম্ভব? সেটাই স্টোকস। ওই দিনটিতে ভুল কারণে ক্রিকেট ইতিহাস মনে রাখবে যাঁকে।
সময়ের স্রোতে সেই স্টোকস সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন কী আশ্চর্য বীরত্বে! ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে। অ্যাশেজে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালেও।
নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চে এক ক্রীড়া পরিবারে জন্ম স্টোকসের। বাবা গেড স্টোকস ছিলেন রাগবি খেলোয়াড়। আন্তর্জাতিক রাগবি লিগে প্রতিনিধিত্ব করেছেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে। মা দেবোরাহ স্টোকস ব্রিটিশ নাগরিক।
১২ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে স্টোকস পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। ক্রিকেটে হাতেখড়ি সেখানেই। বাবার রাগবিতে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত খেললেও পছন্দের শীর্ষে সবসময়ই ছিল ক্রিকেট। খেলতেন কোকারমাউথ স্কুল দলের হয়ে।
২০০৯ সালে ডারহামের হয়ে ‘লিস্ট এ’ ক্রিকেটে অভিষেক ১৮ বছর বয়সী অলরাউন্ডারের। সারের বিপক্ষে ম্যাচে নিজের তৃতীয় বলেই তুলে নেন মার্ক রামপ্রকাশের উইকেট।
পরের বছর স্টোকস ডাক পান ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে। ২০১০ সালের সেই আসরে দলের হয়ে করেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬৬ রান। দলের একমাত্র সেঞ্চুরিও তাঁর ব্যাটেই। জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে পড়ে যান তিনি।
ডাক পান ইংল্যান্ড দলে। তবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা ঠিক মনে রাখার মতো ছিল না স্টোকসের জন্য। ২০১১ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। ১০ বলে করেন মাত্র ৩ রান। বোলিংয়ের সুযোগ পাননি।
ইংল্যান্ডের জার্সিতে প্রথম ৫ বছরের ক্যারিয়ার গড়পড়তা। আর ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের পর তো স্টোকসের ক্যারিয়ার নিয়ে উঠে যায় প্রশ্ন। সমালোচনা আরও প্রবল ২০১৭ সালে। ব্রিস্টলে এক পানশালার বাইরে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
ক্যারিয়ার কি তাহলে এখানেই শেষ? ইডেন-ব্রিস্টল কি পিষে মারবে স্টোকসকে? কিন্তু না। এরপরই যেন নতুন এক স্টোকস। নিজের অবস্থান শুধরে ঠাণ্ডা মেজাজে নতুন আবির্ভাব।
স্টোকসকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনি ক্যারিয়ারের কোন সালটি আবারও ফিরে পেতে চান? উত্তরটি সহজ। ২০১৯। কেননা তাঁর ক্যারিয়ারের আসল কাব্য রচিত এই সালেই।
১৪ জুলাই, ২০১৯। ২৭ বছর পর আবারও ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংলিশরা। এর আগে তিন বারেই ফাইনালে শিরোপা দেখা পায়নি দলটি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি বিশ্বকাপ ফাইনাল ইতিহাসের সেরা ফাইনাল। এর সঙ্গে হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন না কেউই। নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২৪২ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৮৬ রানেই টপ-অর্ডারের চার উইকেট হারিয়ে চাপে ইংল্যান্ড। সেখান থেকে জশ বাটলারকে নিয়ে ১১০ রানের জুটি স্টোকসের। বাকিটা পথ প্রায় একাই।
শেষ ওভারে জিততে দরকার ১৫ রান। প্রথম দুই বল ডটের পর ট্রেন্ট বোল্টের তৃতীয় বলে ছক্কা হাঁকান স্টোকস। চতুর্থ বলে দুই রান নেয়ার সময় মার্টিন গাপটিলের করা থ্রো সোজা স্টোকসের ব্যাটে লেগে বাড়তি চার রান। অর্থাৎ ছক্বা না মেরেও ওই বলে ৬ রান।
প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপের সঙ্গে তখন ২ বলে ৩ রানের দূরত্বে ইংল্যান্ড। দুটো বলেই স্টোকস স্ট্রাইকে। কিন্তু এক, এক করে দুই রানের বেশি নিতে পারেননি। ম্যাচ টাই। সুপার ওভার। ৯৮ বলে স্টোকসের হার না মানা ৮৪ রানের অপূর্ব ইনিংসে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ ফাইনাল গড়াল সুপার ওভারে। সেখানে স্টোকস-বাটলার তোলেন ১৫ রান। নিউজিল্যান্ডও সুপার ওভারে ১৫ রান করে। তবে বেশি বাউন্ডারী মারার কারণে ম্যাচের বিজয়ী ইংল্যান্ড। প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপেরও বিজয়ী।
প্রায়শ্চিত্তের প্রথম ধাপ পূর্ণ স্টোকসের।
এরপর দ্বিতীয় ধাপ। হেডিংলিতে। অ্যাশেজে। বিশ্বকাপ জয়ের মাসখানেক পরেই। কালজয়ী এক ইনিংসে স্টোকস নিজেকে তুলে নিলেন আরও উচ্চতায়। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ মোটে ৬৭ রান। ৩৫৯ রানের লক্ষ্য দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ২৮৬ রানেই ৯ উইকেট হারায় স্বাগতিকরা। জয়ের জন্য তখনও প্রয়োজন ৭৩ রান। হাতে মোটে এক উইকেট। সেখান থেকেই স্টোকসের আরেক মাস্টারস্ট্রোক। জ্যাক লিচকে নিয়ে শেষ উইকেটে ৬২ বলে অবিচ্ছিন্ন ৭৬ রানে ম্যাচ জেতানো জুটি। যেখানে লিচের অবদান ১৭ বল টিকে থেকে মাত্র ১ রান!
আর স্টোকসের অপরাজিত ১৩৫ রানের ইনিংস এই শতাব্দীতে অ্যাশেজের অন্যতম সেরা। নিঃসন্দেহে।
ক্যারিয়ারে তখন পার করছিলেন নিজের সোনালি সময়। কিন্তু বাবার আকস্মিক মৃত্যু বদলে দিল সব। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মারা যান স্টোকসের বাবা জেড।
২০২১-এ আইপিএলে খেলতে গিয়ে পড়লেন ইনজুরিতে। কিছুদিন বাদেই সব ধরণের ক্রিকেট থেকে ছয় মাসের সাময়িক অবসরে স্টোকস। মানসিক অবসাদের কারণ থেকেই নিয়েছিলেন এমন সিদ্ধান্ত।
সেখান থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন স্টোকস। ২০২২-এর এপ্রিলে ইংল্যান্ডের ৮১তম টেস্ট অধিনায়ক হয়েছেন।
সেটাও বড্ড প্রতিকূল সময়ে। আগের ১৭ টেস্টে ইংল্যান্ডের জয় ছিল মাত্র একটি। কিন্তু স্টোকসের ক্যাপ্টেন্সি আর ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কোচিং শুরু হল ইংল্যান্ডের নতুন টেস্ট অধ্যায়।
জুনে বর্তমান টেস্ট চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে জিতলেন সবকটি। এখন পর্যন্ত স্টোকসের অধীনে ১৩ টেস্টের ১০টিতেই জিতেছে ইংল্যান্ড।
আর প্রায়শ্চিত্তের তৃতীয় ধাপ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়। ২০২২ সালে। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তে ৪৯ বলে ৫২ রানে অপরাজিত স্টোকস। ৬ বছর আগে যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চ তাঁর সব কেড়ে নিয়েছিল, সেই মঞ্চেই প্রাপ্তির পূর্ণতা ইংল্যান্ডের এই অলরাউন্ডারের।
২০১৬ তে ভিলেন, ২০১৭ তে মারামারির ঘটনা, ২০২১ এর সাময়িক অবসর সবগুলো ছাপিয়ে স্টোকস নিজেকে প্রমাণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
‘জীবনের পেরিয়েছে ৩১ বছর
লিখেছেন নানান কাব্য
ক্রিকেটেই দেখেছেন অবসাদ
ক্রিকেটেই পেয়েছেন আরোগ্য।’
বিদ্বেষীরাও হয়তো এখন বলতে বাধ্য, আপনি ইংল্যান্ড ক্রিকেটের আধুনিক সময়ের এক মহানায়ক বেন স্টোকস।
মন্তব্য করুন: