শাহেন শাহ হতে পারবেন শাহিন শাহ?
২৯ এপ্রিল ২০২৩
২৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের ফাইনালে মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। বিশ্বকাপ জয়ের সাক্ষী হতে খাইবার পাখতুনখোয়ায় টেলিভিশন পর্দার সামনে অজস্র ভক্তের মধ্যে ছিলেন সাত বছর বয়সী শিশুটিও। পাকিস্তানের হাজারও ভক্তের মতো তাঁর হৃদয়ও ভেঙ্গেছিল সেদিন। হয়তো সেদিন থেকেই স্বপ্ন, দেশকে একদিন এনে দেবেন বিশ্বকাপ । বল হাতে করবেন রাজত্ব।
২০২২ সালে আবারও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে পাকিস্তান। নতুন বল হাতে সময়ের অন্যতম সেরা গতিদানব ১৫ বছর আগের সেই ছোট্ট ছেলেটি। শাহিন শাহ আফ্রিদি।
প্রথম ওভারেই উড়িয়ে দিলেন প্রতিপক্ষ ইংলিশ ওপেনারের উইকেট। কিন্তু কাল হল ইনজুরি। নিজের তৃতীয় ওভারের প্রথম বলের পর হাঁটুর ইনজুরির কারণে বাধ্য হন মাঠ ছাড়তে। পুরো ম্যাচে তাঁর উপস্থিতি হয়তো বদলে দিতে পারত ম্যাচের সমীকরণ। সবুজ জার্সি গায়ে হয়তো উঁচিয়ে ধরতেন শিরোপা।
তবে বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও এখন পর্যন্ত শাহিনের যে ক্রিকেটীয় যাত্রা, সেটি বিস্ময়কর। ভবিষ্যত যে আরও কত অর্জনের ডালা সাজিয়ে বসে আছে এই স্পিডস্টারের জন্য!
খাইবার এজেন্সি লেন্ডি কোটালে মধ্যবিত্ত এক পরিবারে জন্ম শাহিনের। বাবা আয়াজ খান আফ্রিদি সরকারি কর্মকর্তা। সাত ভাইবোনের মধ্যে শাহিন সবার ছোট।
বড় ভাই রিয়াজ আফ্রিদিও ছিলেন ক্রিকেটার। পেস বোলার। পাকিস্তানের জার্সিতে একটা ম্যাচও খেলেছেন; ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টে। দুটি উইকেটও পান। তবে প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে। আর কখনও জাতীয় দলের হয়ে খেলা হয়নি রিয়াজের।
রিয়াজের ক্রিকেটীয় জীবন ছিল অপূর্ণ। সেখানেই যেন পূর্ণতা এনে দেন বয়সে ১৫ বছরের ছোট ভাই শাহিন।
শাহিন শুরুতে মজেছিলেন টেপ টেনিসের ক্রিকেটে। পাচ্ছিলেন সাফল্যও। কিন্তু বড় ভাই রিয়াজ তাঁর মধ্যে দেখেন প্রতিভা। এর যথার্থ বিকাশের জন্য পরিবারের লেন্ডি কোটালে থেকে গেলেও শাহিনকে নিয়ে পেশোয়ারে পাড়ি জমান বড় ভাই।
মধ্যবিত্ত পরিবার, বড় ভাই সাবেক ক্রিকেটার। মনে হতে পারে, শাহিনের ক্রিকেটের শুরু হয়তো সহজই ছিল। আসলে কি তাই?
পেস বোলারদের এমনিতেই হাড়ভাঙা খাটুনি। শাহিনও পরিশ্রম করতেন খুব। সঙ্গে বড় ভাইয়ের দিকনির্দেশনা তো ছিলই। সব মিলিয়ে সামর্থ্যের জানান দিচ্ছিলেন অল্প বয়সেই।
২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায়ের এক ট্যালেন্ট হান্টের আবিস্কার শাহিন। বল হাতে দুর্দান্ত গতি, সাথে শারীরিক ফিটনেস। নজর কাড়েন জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচকদেরও। ক্রিকেটীয় জীবনের প্রথম পুরস্কার অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলে সুযোগ।
পরের বছরেই ডাক পান অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে ৩ ম্যাচে নেন ৫ উইকেট।
পরের বছর পাকিস্তানের আন্তঃজেলা অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে শাহিনের পারফর্ম ছিল চোখ ধাঁধানো। ২৯ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক তিনি।
একই বছরে কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অভিষেক। লেন্ডি কোটাল এক্সপ্রেসের হয়ে প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত শাহিনের। দ্বিতীয় ইনিংসে একাই নেন ৮ উইকেট। পাকিস্তান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ইতিহাসে অভিষেক ম্যাচের সেরা বোলিং এটি।
পরের বছরই পাকিস্তানের জার্সিতে পথচলা শুরু বাঁহাতি এই ফাস্ট বোলারের। টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি সব ফরম্যাটেই। এবং আলো ছড়াচ্ছেন সব ফরম্যাটেই।
সেটা এতটাই যে, প্রথম পাকিস্তানি ক্রিকেটার হিসেবে পেয়েছেন আইসিসির বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের খেতাব। জিতেছেন স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি।
ফাস্ট বোলার তিনি। আততায়ীর মতো ইনজুরি এসে হানা দেয় প্রায়শ। শাহিন তবু ভেঙে পড়েন না। বরং লড়াই চালিয়ে যান চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায়।
এরই মধ্যে শাহিনের ব্যক্তিগত জীবনে আরেক আনন্দের সংবাদ। বিয়ে করেছেন তিনি। পাকিস্তানের তুমুল জনপ্রিয় সাবেক ক্রিকেটার শহিদ আফ্রিদির মেয়েই শাহিন আফ্রিদির স্ত্রী।
বিয়ের পর ইনজুরি কাটিয়ে আবার ফেরেন ক্রিকেটে। তাঁর অধিনায়কত্বে পিএসএলে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জিতে লাহোর কালান্দার্স।
পাকিস্তান হচ্ছে পেস বোলার তৈরির কারখানা। ইমরান খান, সরফরাজ নওয়াজ, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতার, মোহাম্মদ আসিফ, মোহাম্মদ আমির। সে তালিকায় পাকিস্তানের ফাস্ট বোলিং ঐতিহ্যে সর্বশেষ সংযোজন শাহিন শাহ।
বয়স তাঁর মাত্র ২৩ বছর। ইনজুরি যদি প্রবল ছোবল না দেয়, তাহলে গতির ঝড়ে ক্রিকেটের অনেক রেকর্ডই হয়তো উড়িয়ে দেবেন শাহিন শাহ। হয়ে উঠবেন ফাস্ট বোলিংয়ের শাহেন শাহ।
মন্তব্য করুন: